নানা বরণ গাভী রে ভাই একই বরণ দুধ, জগৎ ভরমিয়া দেখলাম একই মায়ের পুত
পূর্ব বাংলার মুসলমান সমাজেই হোক, আর পশ্চিম বাংলার হিন্দু সমাজেই হোক, বাউলরা সবসময় সমাজের মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন। প্রতিটি সমাজ তাদেরকে একঘরে করে রাখে। সামাজিক সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত বাউলেরা অর্থ উপার্জনের ক্ষেত্রেও অনেক পিছিয়ে থাকে। যেহেতু দিনের বেশীরভাগ সময়ই তাদের কাটে সাধনায়। তাই ঘর সংসার গোছানোর জন্য পর্যাপ্ত সময় বাঁচেনা। ভাঙাচুরা থাকার ঘরটা তাদের আসল ঘর নয়। দেহ ঘরটা নিয়েই তারা ব্যাস্ত থাকেন। সাধনার বলে মাটির দেহকে তারা সোনার মত দামী করে তোলেন। বাহ্যিক দৃষ্টিতে বাউলকে একজন দরিদ্র, খামখেয়ালী স্বভাবের, সংসার বিরাগী, উদাসীন মানুষ মনে হতে পারে। কিন্তু অন্তরের ধনে তারা এতটাই ধনী থাকেন যে, ভৌত সম্পদে তাদের মোহ একেবারে কেটে যায়। জাগতিক লোভ লালসা তাদেরকে আর বিচলিত করতে পারেনা। একজন দিব্যজ্ঞানী বাউল কামে থেকেও নিস্কামী, ভোগে থেকেও ত্যাগী হন। পাপে লিপ্ত হয়েও তিনি নিস্পাপ থাকেন। বাইম মাছ যেমন কাদায় বাস করে, অথচ তার গায়ে কাদা লাগেনা। একজন সাধক তেমনি হয়ে থাকেন। কচুপাতা যেমন পানিকে ধারণ করলেও পানিতে সিক্ত হয়না, তেমনি একজন বাউল সংসারের পঞ্চদুঃখকে ভোগ করেও সদা থাকেন আনন্দবাজারে। বাউলের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে লোকের মধ্যে নানা কথা প্রচলিত আছেন। কেউ বলেন বাউল শাহ, অর্থাৎ মুসলমান, কেউ বলেন বাউল সাঁই, অর্থাৎ হিন্দু। কেউ বলেন ওদের কোনো জাতপাত নেই। ওরা নাস্তিক। কিন্তু বাউল বলেন, আমি সবার। মরুর বালুকাময় মধ্যপ্রাচ্য আল্লাহর সৃষ্টি। নাতিশীতোষ্ণ, নদীবেষ্টিত সবুজ শ্যামল ভারতবর্ষ ভগবানের সৃষ্টি। তিব্বত, মঙ্গল প্রভৃতি দুর্গম পাহাড়ী অংশ স্বয়ং বুদ্ধ সৃষ্টি করেছেন। অপরদিকে বরফাচ্ছাদিত অংশের স্রষ্টা গড। প্রধানত তারা চারজন মিলেই জগত সৃষ্টি করেছেন। তবে ছোটো ছোটো কিছু অঞ্চল সৃষ্টিতে অন্যান্য দেবতাদেরও হাত রয়েছে। সকল দেবতার আদেশ থেকে পছন্দনীয় অংশ সংযোজন করে বাউল গড়ে তুলেছে তার নিজস্ব ধর্মমত। এ ধর্মকে সর্বধর্ম নামে ডাকা যায়। এই বইয়ের বিভিন্ন অধ্যায়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।